রাধাঅষ্টমীর উপবাস কি আধা? নাকি দিনান্ত?


 রাধাষ্টমী ব্রত পালনের ক্ষেত্রে অর্ধবেলা উপবাস কেবল মাত্র অসমর্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই শাস্ত্রীয় বিধি--

----------------------------------------------------------------------


আজ আমার প্রেমময়ী শ্রীমতি রাধা রাধারানীর আবির্ভাব তিথি। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এই তিথিটি পালন করে থাকেন। পদ্মপুরাণে রাধাষ্টমী ব্রত মাহাত্ম প্রসঙ্গে দেবর্ষি শ্রীনারদের প্রতি পরম বৈষ্ণব মহাদেব বলেছিলেন- 


হে দেবর্ষি!


 ব্রহ্মা প্রমুখ মহান সত্তমগনের নিত্য মহারাধ্যা যিনি, দেবতাগন দূর থেকে যার সেবা করতে ইচ্ছা করেন,

সেই শ্রীশ্রী রাধিকাদেবীকে সতত ভজনা করা উচিত।


 এই রাধানাম যে ব্যাক্তি শ্রীকৃষ্ণনামের সঙ্গে কীর্তন করেন, তার মাহাত্ম্ আমি কীর্তন করতে সক্ষম নই, এমনকি শ্রী অনন্তদেবও নন।


প্রপঞ্চ লীলায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা স্বরূপশক্তি গোলোকেশ্বরী রাধারাণী ভাদ্র মাসে শুক্লা অষ্টমী তিথিতে অনুরাধা নক্ষত্রে সোমবারে মধ্যাহ্ন কালে ব্রজমণ্ডলে শ্রীগোকুলের অনতিদূরে রাভেল নামক গ্রামে শ্রীবৃষভানু রাজা ও কীর্তিদা মায়ের ভবনে সকলের হৃদয়ে আনন্দ দান করে আবির্ভুত হন।


শ্রীমতি রাধারাণীর করুণার তত্ত্ব, এবং রাধাষ্টমী তিথির সম্যক মাহাত্ম প্রাননাথ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যতিত আরো কারো পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।


শ্রী পদ্মপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড ৭/৮) বলা হয়েছে-


একাদশ্যাঃ সহস্রেন যং ফলং লভতে নরঃ।

রাধা জন্মাষ্টমী পুণ্যং তস্মাং শত গুণাধিকম্।।


"একহাজার একাদশী ব্রত পালন করলে যে ফল লাভ হয়, শ্রীরাধাষ্টমী ব্রত পালন করলে তার চেয়ে

শতগুন অধিক ফল লাভ হয়ে থাকে।"


আরও বলা হয়েছে,


*কোটি জন্মের অর্জিত পাপরাশি ভক্তিপূর্ণ রাধাষ্টমী ব্রত ফলে বিনষ্ট হয়।


*সুমেরু পর্বত সমান সোনা দান করলে যে ফল লাভ হয় একটি মাত্র রাধাষ্টমী ব্রত উদযাপন করে তার শতগুন অধিক ফল লাভ হয়।


*গঙ্গা ইত্যাদি সমস্ত পবিত্র তীর্থে স্নান করে যে ফল লাভ হয়, একমাত্র বৃষভানুকন্যার জন্মাষ্টমী পালন করে সেই ফল লাভ হয়।


 পদ্মপুরাণে আরো বলা হয়েছে-


রাধাষ্টমী ব্রতং তাত যো ন কুর্য্যাচ্চ মূঢ়ধী।

নরকান্ নিষ্কৃতি নাস্তি কোটিকল্পশতৈরপি।।


"যে মূঢ় মানব রাধাষ্টমী ব্রত করে না, সে

শতকোটি কল্পেও নরক থেকে নিস্তার পেতে পারেনা।"


 স্ত্রীয়শ্চ যা না কৃবন্তি ব্রতমেতদ্ সুভপ্রদম। রাধাকৃষ্ণপ্রীতিকরং সর্বপাপপ্রনাশম্।।

অন্তে যমপুরীং গত্বা পতন্তি নরকে চিরম্।

কদাচিদ্ জন্মচাসাদা পৃথিব্যাং বিধবা ধ্রুবম্।।


"যে নারী শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের প্রীতিকর সর্ব পাপনাশক এই শুভপ্রদ মহাব্রত পালণ করে না, সে জীবনের অন্তকালে নরকে গিয়ে চিরকাল সেখানে যাতনা ভোগ করে। পৃথিবীতে থাকাকালীনও সে দুর্ভাগিনী হয়।"


*এই মহাব্রত করলে শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণের অভয় পাদপদ্মে অচলা ও অব্যভিচারিনী ভক্তি লাভ হয়ে থাকে।


এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক,


রাধাষ্টমী ব্রতের উপবাস কতক্ষণ করতে হবে এই বিষয়টি জানার জন্য প্রবন্ধটি লিখার পূর্বে শতাধিকের উপরে কল রিসিভ করেছি। সবাইকে জ্ঞাত করার মনোরথে আজকের এই দিব্য সন্দেশ!


শ্রীশ্রী রাধাষ্টমীসহ অন্যান্য বৈষ্ণব ব্রত পালন করার বিষয়ে সম্পূর্ণ দিন ব্রত পালন করা কিংবা অভিষেক করার পর তিথি অন্তে পারণ করার বিধান দুটিই শাস্ত্র সম্মত। 


গড়ুর পুরাণ এই প্রসঙ্গে বলেছেন-


তিথ্যন্তে চোৎসবান্তে বা ব্রতীকুর্ব্বীতত পারণ!


অর্থাৎ ব্রতী তিথি অন্তে কিংবা উৎসব অন্তে পারণ করতে পারেন।


বায়ুপুরাণেও উক্ত সিদ্ধান্তটি স্বীকৃত।


শ্রীমতি রাধারানীর আবির্ভাব দুপুরবেলা। তাই অনেক ভক্তই দুপুরে অভিষেক করে অন্ন প্রসাদ পেয়ে নেন। তবে এই বিধান কার জন্য আমরা এই বিষয়ে এখন আলোকপাত করবো----


***বৈষ্ণব চূড়ামণি সনাতন গোস্বামীপাদ কেবল মাত্র অসমর্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তিথি কিংবা অভিষেক অন্তে পারণকে অনুমোদন করেছেন**


অসমর্থ ব্যক্তি বলতে সনাতন গোস্বামীপাদ বুঝিয়েছেন- যাদের বয়স অনেক হয়ে গিয়েছে, যারা রোগে শোকে আক্রান্ত, তারাই কেবল তিথি অন্তে অনুকল্প গ্রহণ করতে পারবেন।


বর্তমানে অনেকেই সমর্থ হওয়ার পরও অসমর্থের দোহাই দিয়ে দুপুর ১২ টার পরই পেট ভরে অন্ন খেয়ে নেন। আবার অনেকেই নিজেরা অসমর্থের দলে আছেন বলে অন্যদের নিকটও দুপুর ১২ টা পর্যন্ত উপবাস বলে প্রচার করছেন, যা সত্যিই দুঃখজনক। এমনকি মহাপ্রভু এবং ষড়গোস্বামীপাদের আইনের বিরুদ্ধ আচরণ।


আমার শরীরে যৌবন শক্তি রয়েছে, আমি সবল এবং কর্মকক্ষম, এমন থাকার পরও আমি কি অসমর্থের দলে? আমি দুপুর ১২ টার পর পেট ভরে খাব, এবং অন্যকেও অসমর্থের দলে আনতে প্রচার করবো?


স্বয়ং বিচার করুন-------!


একটা দিন কৃষ্ণ প্রেম তরঙ্গিনী শ্রীমতি রাধারানীর জন্য না খেয়ে তাঁর গুণ মহিমা কীর্ত্তন করতে পারিনা? যে রাধা রানীর প্রেমে জগত বশীভূত, এমনি স্বয়ং ভগবান গোবিন্দ পর্যন্ত বশীভূত-


মুই পীতবাস রাধারানীর দাস, তিলেক সংশয় যার।

কোটি জন্ম যদি ভজয়ে আমারে, বিফল জনম তার।।


আহারে! কি করুণ আর্তনাদ ভগবানের! এই প্রাণমাতানো অভিব্যক্তির পরও রাধাষ্টমী ব্রত পালনে এই অবহেলাপূর্ণ আচরণ বৈষ্ণব ভক্তদের সত্যি কষ্ট দেয়।


তাছাড়া ভবিষ্যপুরাণে সূত-শৌনক সংবাদে রাধাষ্টমীব্রত কথা প্রকরণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নারদ সংবাদে বলা হয়েছে-


ভাদ্রে মাসি সিতে পক্কে অষ্টমী যা তিথির্ভবেৎ।

তস্যাং অনুরাধা নক্ষত্রে দিনার্দ্ধেহভিজিতেক্ষণে।।

অতীব সুকুমারাঙ্গীং কীর্ত্তিদা অসুত কন্যকম্।।

এবং সদনুসন্ধানৈস্তাং তিথিং সমুপোষয়েৎ।

পরেহহ্নি পারণং কুর্য্যাৎ বৈষ্ণবেঃ সহ বৈষ্ণবঃ।।


ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবর্ষি নারদকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-


ভাদ্রমাসে, শুক্লাপক্ষ অষ্টমী তিথি, অনুরাধা নক্ষত্র, মধ্যাহ্নে, অভিজিৎযোগে, শুভ ক্ষণে কীর্ত্তিদা সুন্দরীর কোল আলো করে রাধারানী আবির্ভূত হন। সাধুগণ তাদের পারমার্থিক মঙ্গলের জন্য সেই তিথিতে উপবাস করবেন এবং পরদিন বৈষ্ণবগণের সঙ্গে বৈষ্ণবগণ পারণ করবেন।


ভগবান স্বয়ং নারদকে উদ্দেশ্য করে এই উপবাস এবং নির্দিষ্ট সময়ে পারণের বিধান দিয়েছেন। এখন কেউ যদি অপারগতার দোয়াই দিয়ে দুপুরে রাধারানীর অভিষেক করে অন্ন প্রসাদ গ্রহণ করে নেন, এটা তার ব্যক্তিগত অভিরুচি।


তবে অবশ্যই তিনি যে অসমর্থের দলে শাস্ত্রীয় বিচারে তার কোন সন্দেহ নেই।


সুতরাং সহৃদয়বান পাঠক বৃন্দ, 


এবার আপনারাই শাস্ত্রের আঙ্গিকে বিচার করে সিদ্ধান গ্রহণ করুন- দুপুর ১২ টা পর উপবাস ভঙ্গ করে পারণ করবেন, না পরের দিন নির্ধারিত সময়ে উপবাস ভঙ্গ করে পারণ করবেন???


লিখেছেন শ্রী প্রদীপ রুদ্র

No comments:

Post a Comment

সাবিত্রী-সত্যবান এবং সনাতন

  সাবিত্রী ও সত্যবান: একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ সাবিত্রী ও সত্যবানের কাহিনী সনাতন ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক নারী-আদর্শ ও প...